নিজস্ব প্রতিবেদক:-
ভারত ও নেপালের মধ্যে বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে নেপালিদের মিল থাকায় সেই বন্ধুত্ব আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। কিন্তু সেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে চাইছে কেউ কেউ।
স্বার্থান্বেষীমহলের প্ররোচনায় কিছুটা হলেও উত্তেজনা দেখা দিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দুই শান্তিপ্রিয় প্রতিবেশীর মধ্যে। ভারত-নেপাল সম্পর্কের অবনতি অবশ্যই বাংলাদেশকে উদ্বেগে রাখবে।
কারণ নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হলে ভারতের ট্রানজিট সুবিধা লাগবে। এছাড়াও রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি বজায় রাখার বাধ্যবাধকতাও।স্বাধীন ভারতে পন্ডিত জওহরলাল নেহরুরর আমল থেকেই নেপালের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক বজায় রয়েছে।
সেই সময় থেকেই নেপালের উন্নয়নের অন্যতম শরিক ভারত। এমনকী, ভারতীয় সেনা-আধাসেনা বাহিনী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ রয়েছে নেপালের নাগরিকদের।
অবসরের পর তাঁরা ভারতীয়দের মতোই সুবিধাও ভোগ করেন। উভয় দেশের নাগরিকদেরই বিনা পাশপোর্ট-ভিসায় অবাধে যাতায়াতেরও সুবিধা রয়েছে।
মাত্র ২ কোটি ৯০ লাখ মানুষের বসবাস নেপালে। ১৩০ কোটির দেশ ভারতের তূলনায় অনেক ছোট। তবু কখনও দাদাগিরি দেখায়নি ভারত। বরং সময়ের প্রয়োজনে বারবার উদার হয়েছে নেপালের প্রতি।
সেখানকার অভ্যন্তরীন রাজনীতিতেও ভারত নাক গলায়নি। অনেকেই ভেবেছিলেন, নেপালকে গ্রাস করবে দিল্লি। কিন্তু নিজেদের পররাষ্ট্রনীতির প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা দেখিয়ে কখনওই প্রতিবেশীর সঙ্গে এমন আচরন করেনি। বরং প্রতিবেশীর বিপদে পাশে থেকেছে ভারত।
কমিউনিস্ট আগ্রাসন বা ভূমিকম্প, সব বিপদেই নেপালের পাশে সবার আগে পৌঁছে গিয়েছে ভারত। নেহরুর আমলে যে সম্পর্কের ভীত গড়া হয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে সেটা আজ প্রাসাদের চেহারা নিয়েছে।
নেপাল নীতি ইন্দিরা গান্ধি বা মনমোহন সিং কেউই বদলাননি। বরং সরকারে যেই থাকুন না কেন, বন্ধুত্বকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে ভারত।
১৯৫০ সালের ৩১ জুলাই নেপাল ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক ইন্দো-নেপা শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি। কাঠমান্ডুতে নেপালি প্রধানমন্ত্রী মোহন শামসের জং বাহাদুর রানা ও ভারতের তখনকার রাষ্ট্রদূত সি এন সিং-এর মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি বন্ধুত্বের প্রথম ধাপ। কিন্তু পারষ্পরিক বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার জন্য সম্পাদিত এই চুক্তি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনের প্রয়োজন অনুভূত হয়।
তাই প্রধানমন্ত্রী মোদি নেপাল সফরে জানিয়ে দেন, ভারত চুক্তি পুনর্বিবেচনায় রাজি। আসলে কোনও বিতর্কেই জড়াতে রাজি নয় ভারত। চিরস্থায়ী বন্ধুত্বেই বিশ্বাসী নির্জোট আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা দেশটি।
১৯৫২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির ভেক ধরে প্রতিবেশী চীন যখন নেপাল দখলের চেষ্টা করে, সবার আগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ভারত। পাশাপাশি নেপালের পরিকাঠামো উন্নয়নেও ভারতের ভূমিকা সবসময়ই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কাঠমান্ডুর গাউচরণে দেশের প্রথম বিমানবন্দর নির্মাণ থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সড়ক যোগাযোগ, শিল্প-বানিজ্য, সবকিছুতেই দিল্লির অবদান সবচেয়ে বেশি।
এমনকী, ২০১৫ সালের সর্বনাশা ভূমিকম্পের পর সবার আগে ভারতীয়রাই পৌঁছে যান ত্রান ও উদ্ধারকাজে। নেপাল পুনর্গঠনেও প্রতিশ্রুতি পালন করেছে দিল্লি।নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও ভালো।
সেখানকার কার্নালি নদীর ৯০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুত প্রকল্প থেকে বিদ্যুত আনতে চায় বাংলাদেশ। ২০১৮ সালেই ভারত সম্মতি দিয়েছে নিজেদের গ্রিড ব্যবহারের। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আমলেই ঠিক হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল রেল রুট স্থাপনের।
বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে হবে এই ট্রানজিট রুট। আমদানি-রপ্তানি ক্ষেত্রে কাঁকরভিটা-বাংলাবান্দা স্থলবন্দর পাবে আরও গুরুত্ব। এছাড়াও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের বানিজ্য ক্ষেত্রে সবরকম সহায়তা দিচ্ছে ভারত। ভারতীয় জমিকে ব্যবহৃত হচ্ছে ট্রানজিট হিসাবে। আসলে ঢাকা ও কাঠমান্ডু উভয়ের সঙ্গেই সুসম্পর্ক চায় ভারত।
প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুম্পর্ক বজায় রাখাই তো ভারতের নীতি। মোদিরও সাফকথা, নেইবরহুড ফার্স্ট। অর্থাত প্রতিবেশীর স্বার্থকে অগ্রাধিকার নীতিতেই অটল ভারত।নেহরুর আমল থেকেই তো প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে চেয়েছে ভারত। তাঁর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধিও বজায় রেখেছিলেন সেই ধারা। কিন্তু অনেকেরই সেটা সহ্য হয়নি। ভুল বোঝানোর চেষ্টা চলে। চলে অপপ্রচার, বিভ্রান্তী। কিন্তু নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়েই নেপাল সেদিনও বুঝেছিল ভারত প্রকৃত অর্থেই নেপালের বন্ধু।
১৯৭৫ সালের রাজা বীরেন্দ্রের ঐতিহাসিক দিল্লি সফর সম্পর্কের উন্নতিতে নতুন ফলক হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। ভারতে জরুরি অবস্থার পরবর্তীতে ইন্দিরা গান্ধি ক্ষমতাচ্যুত হলে তাঁকে আশ্রয় দিতে চেয়েছিলেন রাজা বীরেন্দ্র। কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রে পরাজিত রাষ্ট্রনায়ককে কখনওই বিদেশে আশ্রয় নিতে হয়নি। ইন্দিরা ভারতেই ছিলেন। পরে ফের প্রধানমন্ত্রী হয়েও নেপালের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখেন। সেই ধারাই অব্যাহত।
ভারত-নেপাল সীমান্ত নিয়ে কোনও বিবাদ নেই। বাংলাদেশ বা পাকিস্তান সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হলেও ১৮৫০ কিমি ইন্দো-নেপাল সীমান্তে নেই তেমন টহলদারিও। সীমান্ত প্রহরায় পেশাদার বাহিনী বিএসএফের বদলে নেপাল সীমান্তে ভারত পাহাড়ার ভার দিয়েছে নব গঠিত এসএসবিকে।
১৯৮১ সালেই সীমান্ত সমস্যা মেটাতে উভয় দেশ গঠন করে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ। পরবর্তীতে আরও একধাপ এগিয়ে সেটাই পরিবর্তিত হয় জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্রুপ। আলোচনার মাধ্যমেই উভয় দেশ সমস্ত সমস্যার সমাধানে বিশ্বাসী। সীমান্ত দিয়ে চলছে অবাধ যাতায়াত। উভয় দেশের নাগরিকরাই তো একে অন্যের দেশে বসবাস করতে পারে।
৬ লাখ ভারতীয় নেপালেই বসবাস করেন। আর নেপালিদের জন্য ভারতে চাকরির দরোজা খোলা।২০১৪ সালের ২৬ মে দিল্লির মসনদে বসেন নরেন্দ্র মোদি। তাঁর শপথে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা। তারপরই মোদির কাঠমান্ডু সফর।
কাঠমান্ডুতে পা দিয়েই তিনি বললেন, ১৯৫০ সালের চুক্তি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব থাকবে। কিন্তু সেটা হবে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল। গুরুত্ব দিলেন হিট-এ হিট। হাইওয়ে, ইনফোয়ে ও ট্রান্সমিশন। নেপালের উন্নয়নের তিন মন্ত্র। আর এই হিট-কেই বাস্তবায়নে কাজ