নিজস্ব প্রতিবেদক:-
শ্রী শ্রী দূর্গাপূজায় ৩ দিনের সরকারি ছুটি ,বিভিন্ন জায়গায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং সারাদেশে হিন্দু নির্যাতনের প্রতিবাদে ও দুস্কৃতিকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে ঢাকা রিপোর্টারস ইউনিটির সাগর রুনী মিলনায়তনে ২১ অক্টোবর ২০২০ বুধবার সকাল ১১ টায় বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট এর উদ্দোগে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
হিন্দু মহাজোটের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডঃ দীনবন্ধু রায় এর সভাপতিত্বে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন অ্যাডঃ গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক,মহাসচিব বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট।
উপস্থিত ছিলেন হিন্দু মহাজোটের সিনিয়র সহ সভাপতি প্রদীপ চন্দ্র পাল, অ্যাডভোকেট লাকী বাছাড়, সাংগঠণিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুজয় ভট্টাচার্য, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক অ্যাড প্রতীভা বাকচী,হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক মহাজোটের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল ঘোষ, ঢাকা দক্ষিনের সভাপতি ডিকে সমির, সাধারণ সম্পাদক শ্যামল ঘোষ,
হিন্দু ছাত্র মহাজোটের সভাপতি সাজেন কৃষ্ণ বল, সাধারণ সম্পাদক সজিব কুন্ডু তপু,যুগ্ন সাধারন সম্পাদক তন্ময় কুন্ডু ,মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মৌসুমি রায়,সহ প্রচার সম্পাদক সুমন কুমার রায়, সমাজকল্যান বিষয়ক সম্পাদক বাধন ভৌমিক প্রমূখ ।
বক্তাগন বলেন দেশে প্রতিদিনই কোন না কোন স্থানে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। গত কয়েক দিনের মধ্যে ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে দুর্গা প্রতিমা ভাংচুর করা হয়েছে। নোয়াখালীর সদর উপজেলায় লক্ষী নারায়নপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ীঘরে অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে। সনাতন বিদ্যার্থী পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক কুশল চক্রবর্তীকে অশ্লীল গালাগালি সহ হত্যার হুমকী দেয়া হয়েছে, ব্রাহ্মনবাড়ীয়ার নাসিরনগর উপজেলার চাপড়তলা ইউপির সংরক্ষিত মহিলা প্রণতি দাসকে ধর্ষন চেষ্টা, প্রাণনাশের হুমকী, ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকী, রাজবাড়ী জেলার নাড়–য়ায় অসিত কুমার বিশ্বাসের বাড়ী দখলের অপচেষ্টা, ফরিদপুরের কানাইপুরে সন্ত্রাসী জসিম গং কর্তৃক নারায়ন মন্ডলকে বাড়ীঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটুক্তির অযুহাতে সুজন দে নামে এক দর্জিকে ৭ বছর কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মিঠুন মন্ডলের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও তার ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়েছে। বরিশালের উজিরপুরে যুথিকা মন্ডল নামে এক কিশোরীকে ধর্ষন করা হয়েছে। হবিগজের লস্করপুর কালি মন্দিরে চুরি হয়েছে। রংপুরে উখিয়া রাউত ও সাভারে নিলা রায় নামে দুই কিশোরীকে ধর্ষন শেষে হত্যা করা হয়েছে। কক্সবাজারে উদীয়মান সঙ্গীতশিল্পী জনি দে কে হত্যা করা হয়েছে। হিন্দু ধর্ম নিয়ে কটুক্তি ডালভাতের মত।
বিভিন্ন ওয়াজ মহফিল, ফেসবুক ম্যসেঞ্জার ইত্যাদিতে হিন্দু ধর্ম নিয়ে নানা বানোয়াট অশ্লীল কেচ্ছা কাহিনী প্রচার করা হচ্ছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এর কোন উত্তর দিলেই ধর্ম অবমাননার অযুহাতে হামলা মামলা ইত্যাদি। ইসলাম ধর্মকে মহান তুলে ধরতে শর্টফ্লিম, নাটক ইত্যাদিতে হিন্দু ধর্ম, রীতি নীতি সমাজব্যবস্থা ইত্যাদিকে হেয় করা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও আজ পর্যন্ত হিন্দু ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করে নাই। সরকার মঠ মন্দির প্রতিমা ভাংচুর ও বাড়ীঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগকারীদেরকে চিহ্নিত ও গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে অপরাধীরা অপরাধ করতে আরও উৎসাহিত হচ্ছে। হিন্দুদের জনজীবন দিন দিন অসহনীয় ও দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে।

দেশে ব্যপকভাবে হিন্দু বাড়ীঘরে মঠ মন্দিরে হামলা হয়েছে, লুঠ-পাঠ অগ্নি সংযোগ, খুন, দেশ ত্যাগে বাধ্যকরণ, ধর্ষন হয়েছে; কিন্তু কারো কোন বিচার হয় নাই বা শাস্তি বিধানও করা হয় নাই। সেকারনে হিন্দু সম্প্রদায় এখনো আতঙ্কগ্রস্থ। করোনার অযুহাতে বিভিন্ন স্থানে পুলিশী নিরাপত্তা বিধানে অনিহা প্রকাশের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। আর একারনে হিন্দু মহাজোট আসন্ন দূর্গাপূজায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা করারও দাবী জানাচ্ছে।
এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে শারদীয় দূর্গাপুজা। সারা বছর হিন্দু সম্প্রদায় এই দিনগুলির দিকে চেয়ে থাকে। পরিবারের সবাই এই ধর্মীয় উৎসবেই একত্রিত হওয়ার জন্য উন্মূখ থাকে; অথচ শুধুমাত্র পুজার শেষের দিন অর্থাৎ বিজয়া দশমীর দিন ১ দিন সরকারী ছুটি থাকায় হিন্দু সম্প্রদায় পরিবার পরিজন নিয়ে ধর্মীয় উৎসব পালন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে। ফলে পিতা মাতার সাথে সন্তানদের এবং স্বামী স্ত্রী সহ পরিবাবের অন্যান্যদের সাথে দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে পারিবারিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ হচ্ছে। বহু আকাঙ্খিত এই দিনগুলি আনন্দের পরিবর্তে বিষন্নতায় পরিণত হয়েছে।
এদেশের হিন্দু সম্প্রদায় আশা করেছিল সংবিধান সমুন্নত রাখতে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভুতির কথা বিবেচনা করে ৫ দিনের শারদীয় দূর্গা পুজায় সরকার অন্ততঃ ৩ দিন সরকারী ছুটি ঘোষণা করবে। দেশের হিন্দু সম্প্রদায় গত ১২ বছর ধরে এই দাবীতে মানববন্ধন, স্মারকলিপি সহ নানা কর্মসূচী পালন করার পরও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করতে ব্যর্থ হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায় আশা করেছিলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার নির্বাহী আদেশে বিষয়টি বিবেচনা করবেন। কিন্তু সারাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের এত আন্দোলন আবেদন নিবেদনের পরও প্রধানমন্ত্রীর কোন ঘোষনা না পাওয়ায় সারাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় হতাশ।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ভদন্ত শরনংকর ভান্তে ২০১২ সালে “জ্ঞান শরন মহারন্য বৌদ্ধ বিহার” নামে একটি বৌদ্ধ বিহার স্থাপন করে ভক্ত শিষ্যদের মাঝে বুদ্ধের মহান শান্তির বাণী প্রচার করে আসছে। সেখানে অনাথ শিশুদের জন্য অনাথ আশ্রমও পরিচালনা করছে। অথচ এলাকার ভূমি দস্যু এরশাদ মাহমুদ কর্তৃক উক্ত বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করার জন্য শরনংকর ভান্তের নামে মিথ্যা ইসলাম ধর্ম অবমাননার অযুহাতে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলে বিতাড়িত করেছে। প্রায় ডজনখানেক মিথ্যা মামলা হয়েছে। বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে তার নিজের প্রতিষ্ঠিত মহাবিহারে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। ভূমি দস্যু সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন ভাড়াটিয়া লোকজন এনে ভান্তের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করাচ্ছে।
এতে করে হিন্দু বৌদ্ধ ও মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের নাশকতা ঘটনার পরিকল্পনা করছে ভূমি দস্যু ও বন খেকোরা। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই এবং অবিলম্বে ভদন্ত শরনংকর ভান্তের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও তাকে তার প্রতিষ্ঠিত মহাবিহারে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সহ স্বাধীনভাবে ধর্ম চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করতে সরকারের কাছে আহ্বান জানাই।
আইন মানুষের কল্যাণের জন্য। সরকার দেশের ও জনগণের নিরাপত্তার জন্য দেশের ও জনগণের কল্যাণের জন্য আইন প্রণোয়ন করে থাকে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনও সে লক্ষে প্রণীত হলেও এই আইনটি শুরু থেকেই এদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়কে নিপিড়নের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ব্রাহ্মনবাড়ীয়ার টিটু রায় থেকে শুরু করে এই আইনে শত শত নিরপরাধ হিন্দু যুবক মিথ্যা মামলায় জেল হাজতে আটক আছে। অথচ সবাই জানে প্রতিটি ঘটনাই পরিকল্পিতভাবে আইডি হ্যাক বা অন্যের নামে ভূয়া আইডি খুলে মিথ্যা মামলা দয়ের করা হচ্ছে। অথচ ওয়াজ মহফিল সহ নানা মাধ্যমে প্রতিদিন হিন্দু ধর্ম নিয়ে কটুক্তি অশ্লীল মন্তব্য করা হচ্ছে।
হিন্দু ধর্ম অবমাননার জন্য মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা গ্রহণ করে না। আমরা হিন্দু ধর্ম অবমাননাকারীদেরকেও আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানাচ্ছি। এরই মধ্যে সুজন দে নামে এক দর্জীকে মিথ্যা মামলায় ৭ বছরের সাজা হয়েছে। আমরা ধর্ম অবমাননার অযুহাতে আটককৃত সকল আসামীর নিঃশর্ত মুক্তি দাবী করছি এবং ধর্ম অবমাননার সকল মিথ্যা মামলার প্রত্যাহার দাবী করছি।
হিন্দু সমাজ শান্তিপূর্ণভাবে সকল মত ও পথের মানুষের সাথে সহ অবস্থানে বিশ্বাসী। সেকারনে আপনাদের মাধ্যমে সরকারের কাছে হিন্দু সম্প্রদায় নি¤েœাক্ত সাংবিধানিকভাবে দাবী উত্থাপন করছে।
১। দূর্গা পুজায় ৩ দিনের সরকারী ছুটি ঘোষণা করে সংবিধানে বর্ণিত সম অধিকার ও সম মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে এবং নির্যাতন নিপিড়নে আতঙ্কগ্রস্থ হিন্দু সম্প্রদায় যাতে নির্ভয়ে ধর্মীয় উৎসব পালন করতে পারে সে লক্ষ্যে আসন্ন দূর্গাপুজায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে।
২। ভদন্ত শরনঙ্কর ভান্তের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা সহ তার প্রতিষ্ঠিত “জ্ঞান শরন মহারন্য বৌদ্ধ বিহারে” যেন শান্তিপূর্ণভাবে ধর্ম চর্চা করতে পারেন তার সুব্যবস্থা করতে হবে।
৩। ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অযুহাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতারকৃত সকল আসামীর নিঃশর্ত মুক্তি ও সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার দাবী করছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কুশল বরন চক্রবর্তীকে অশ্লীল গালিগালাজ সহ হত্যার হুমকীদাতাকে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করে শাস্তি বিধান করতে হবে। সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ী দখল, দেশত্যাগের হুমকী, হত্যার হুমকীদাতাদের গ্রেফতার ও দ্রুতবিচার ট্রাইবুনালে বিচার করে শাস্তি বিধান করতে হবে।
৪। জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলাকালে ও নির্বাচন পরবর্তী হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সহিংসতা ও নির্যাতন নিরোধ কল্পে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে জাতীয় সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত আসন ও পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা পূণঃ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৫। একটি সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে একজনকে পূর্ণ মন্ত্রী নিয়োগ করতে হবে।
আগামী ১৫ নভেম্বর ২০২০ এর মধ্যে সরকারকে উপরোক্ত দাবী বাস্তবায়ন সহ অন্যান্য দাবী বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে অন্যথায় হিন্দু সম্প্রদায় ঢাকায় মহাসমাবেশ সহ সারা দেশের প্রত্যেক জেলা ও উপজেলা সদরে মানব বন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন পূর্বক পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করবে।